কমিউনিটি রেডিও: প্রান্তিক এলাকার কণ্ঠহীনদের কণ্ঠস্বর

Posted by

কমিউনিটি রেডিও এর বয়স প্রায় ৬৫ বছর। প্রতিটি সৃষ্টিরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার যার নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যের কারনে অন্যদের থেকে তা স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করে। রেডিও’র ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।

কমিউনিটি রেডিও

কমিউনিটি রেডিও হচ্ছে কমিউনিটি ভিত্তিক রেডিও। এই গণমাধ্যমে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজেদের কথা সরাসরিভাবে বলার সুযোগ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি; তৈরি হয়েছে কণ্ঠহীনদের কণ্ঠস্বর সোচ্চার হওয়া ও শোনার সুযোগ।

কমিউনিটি ভিত্তিক রেডিওতে সাধারণভাবে সীমিত প্রযুক্তিগত স্থাপনার মাধ্যমে অল্পসংখ্যক মানুষ কাজ করে। সম্প্রচারে ব্যবহৃত হয় এফএম ট্রান্সমিটার।

ভৌগোলিকভাবে এর প্রচার এলাকা ছোট। হতে পারে একটি গ্রাম বা শহরতলি। কিন্তু রেডিও গুলো একটি শক্তিশালী সম্প্রচারকারী দলের তত্ত্ববধানে হয়ে থাকে।

এই নয়া গণমাধ্যম সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশের ক্ষেত্রে পল্লি অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে তথ্য এবং যোগাযোগের অধিকার এনে দিয়েছে।

নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালন করা কম্যুনিটি রেডিও গুলো এলাকাবাসীর অংশগ্রহণ ও তাদের জীবন কেন্দ্রিক সমস্যা ও সম্ভাবনা, চাওয়া- পাওয়া ইত্যাদির উপর অনুষ্ঠান নির্মানে গুরুত্ব দেয়া হয়।

সংবাদ, তথ্য বিনোদন, নাটক, জীর্বিকা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আলোচনা অর্থাৎ স্থানীয় সর্ব বিষয়ে প্রচার প্রক্রিয়ায় এলাকাবাসী সরাসরি অংশগ্রহণ করে।

স্থানীয় যে কোনো গুরুত্বপুর্ণ তথ্য সংবাদ এ কেন্দ্র থেকে স্থানীয় জনগণ পেয়ে থাকে। যার মাধ্যমে বিনোদন, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয় অনুষ্ঠানাদি প্রচার করে।

বাংলাদেশে তথ্য মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রথমবার কমিউনিটি রেডিও পরিচালনার অনুমোদন দেয়। বর্তমানে দেশব্যাপী ১৭ টি কম্যুনিটি রেডিও স্টেশন রয়েছে।

যার প্রত্যেকটিই ১৭ বর্গ কিলোমিটারের পরিধিতে সম্প্রচার করে থাকে, যেগুলোর অধিকাংশই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।

কমিউনিটি রেডিও এর ইতিহাস

কমিউনিটি রেডিওর উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস অর্ধ শতকেরও বেশি সময়ের।  ১৯৪৮ সালে বলিভিয়ায় ‘মাইনার্স রেডিও’ এবং কলম্বিয়ায় ‘রেডিও সুতাতেনজা’ কমিউনিটি রেডিওর প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে অগ্রদূত।

ল্যাটিন আমেরিকায় এর উত্পত্তি। দারিদ্র্য ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এই রেডিও যাত্রা শুরু করে ১৯৪৮ সালে।

সেই প্রেরণায় এখনো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই রেডিও স্থাপন হচ্ছে। মাইনার্স রেডিও মাক্সবাদী ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দ্বন্দ্বের মাঝের শক্তি হিসেবে কাজ করত।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

প্রচার করত খনি শ্রমিকদের উপযুক্ত কাজের পরিবেশ এবং শ্রম নিযুক্তির জন্য জনগণকে সংগঠিত করতে অনুষ্ঠান। শ্রমিকরাই অর্থ দিয়ে পরিচালনা ও সম্প্রচার করত এই রেডিও।

রেডিও সুতাতেনজা সাধারণ মানুষের কাছে এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে বছরে প্রায় ৫০ হাজার চিঠি আসতো। সুতাতেনজা প্রকৃত অর্থে জনগণের পরিচালনায় জনগণের রেডিও হয়ে উঠেছিল এটি।

ল্যাটিন আমেরিকা, অফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে দীর্ঘদিন ধরে কমিউনিটি রেডিও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

সার্কভুক্ত দেশ নেপাল ও শ্রীলংকার উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও কমিউনিটি রেডিওর সাফল্য লক্ষণীয়।  কিন্তু বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওর বিষয়টি এখনও শুরুর পর্যায়ে রয়েছে।

বৈশিষ্ট্য ও উদ্দেশ্য

প্রতিটি সৃষ্টিরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার যার নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যের কারনে অন্যদের থেকে তা স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করে।

কমিউনিটি রেডিওর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।  কমিউনিটি রেডিও হচ্ছে স্থানীয় ছোট্ট বেতার কেন্দ্র। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে এর সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে।

এফ এম বা বেতার কেন্দ্রের হতে পৃথক করার জন্য কমিউনিটি রেডিও’র ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

যা জানা থাকলে কমিউনিটি রেডিও সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকার পাশাপাশি সব ধরণের বিভ্রান্ত এড়ানো সম্ভব। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো।

  • প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করা।
  • প্রান্তিক মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো।
  • স্থানীয় জনগণের লোকজ জ্ঞান, সম্পদ ও সংস্কৃতি, আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো।
  • প্রান্তিক জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা ও তাদের মালিকানায় পরিচালিত।
  • এটি লোকালয় জনগোষ্ঠীর কল্যাণকে প্রাধান্য দেয়-বাণিজ্যিক স্বার্থকে নয়।
  • কমিউনিটি রেডিও এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ঠ্য হলো সেই লোকালয়ের মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণ। এখানে সেই লোকালয়ের কৃষক তার কৃষির কথা বলতে পারছে, কবি তার লেখা কবিতা পাঠ করতে পারছে।

দেশে বর্তমানে ১৭টি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। আর এসব রেডিও স্টেশনে যারা কাজ করেন, তারা সবাই সংশ্লিষ্ট কমিউনিটির মানুষ। কমিউনিটির বাইরে থেকে কারও এখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই।

তারা নিজেরাই সংবাদ ও অনুষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ, অনুষ্ঠানের নির্মাণ, শব্দ সম্পাদনার মতো কাজ করে থাকেন।

আবার কমিউনিটির ভেতর থেকেই নারী ও দলিতদের বাছাই করা হয় ফেলোশিপের জন্য। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন।

সবগুলো কমিউনিটি রেডিওতেই কমিউনিটির নারীরা স্বেচ্ছাসেবক এবং নিজস্ব কর্মী হিসেবে কাজ করছেন।

এমনকি একাধিক কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের ম্যানেজার, সংবাদ ও অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান হচ্ছেন নারী – যারা ওই কমিউনিটিরই মানুষ।

আর সংবাদ ও অনুষ্ঠানের বিষয়ও স্থানীয় সমস্যা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ; জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো কোনো বিষয় নিয়ে সংবাদ ও অনুষ্ঠান নির্মিত হলেও সেটির সঙ্গে ওই কমিউনিটির স্বার্থ যুক্ত রয়েছে কিনা তা বিশেষভাবে খেয়াল রাখা হয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিটি রেডিও

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপালে সর্বপ্রথম এ ধরনের রেডিও চালু হয়৷ অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম কমিউনিটি রেডিও নীতিমালা করে ভারত, ২০০৬ সালে।

আর বাংলাদেশ হচ্ছে কমিউনিটি রেডিও বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়নকারী দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ।

২০০৮ যখন বাংলাদেশ কমিউনিটি রেডিও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়, তখনও দেশে কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচারে আসেনি।

ভারতে বর্তমানে কমিউনিটি রেডিও এবং ক্যাম্পাস রেডিও আছে।

ইউনেসকোর সহযোগিতায় ২০০১ সাল থেকে দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকার মালি, মোজাম্বিক, সেনেগাল, এশিয়ার কিছু অঞ্চল ও ক্যারিবিয়ায় কমিউনিটি রেডিও সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিও 

রেডিও

দেশের উপকূলের অনেক প্রত্যন্ত এলাকা, দ্বীপ ও চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই, নেই টেলিভিশনে খবর দেখার সুযোগও। এমনকি বাংলাদেশ বেতারও শোনা যায় না অনেক জায়গায়।

আর লাখো জেলে, যারা নিয়মিত সাগরে মাছ ধরতে যান, তারা থেকে যান প্রায় অন্ধকারে।

তাই যখনই কোনো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস আসে, তখন সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী।

কিন্তু, কমিউনিটি রেডিওর কল্যাণে গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি ঘটেছে।

যেকোনো দুর্যোগে তারা সময়মতো সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে

২০১১ সাল হতে বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওর কার্যক্রম শুরু হয়।

বর্তমানে ১৯টি কমিউনিটি রেডিও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে নয়টিই উপকূলীয় অঞ্চলে, যাদের মোট শ্রোতা প্রায় ৩০ লাখ।

যে ৩০ লাখ মানুষের একটা বড় অংশই আগে সময়মতো সঠিক তথ্যটা পেতেন না। এই শ্রোতাদের একটা বড় অংশ জেলে।

গবেষণা বলছে, সম্প্রচার এলাকার মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ কমিউনিটি রেডিও শোনেন।

১৯টি রেডিওর তালিকা

  • লোকবেতার (বরগুনা)
  • রেডিও পদ্মা (রাজশাহী)
  • রেডিও-মহানন্দা (চাঁপাই)
  • রেডিও বরেন্দ্র (নওগাঁ)
  • রেডিও-চিলমারি (কুড়িগ্রাম)
  • রেডিও সারাবেলা (গাইবান্ধা)
  • রেডিও-মুক্তি (বগুড়া)
  • রেডিও নলতা (সাতক্ষীরা)
  • রেডিও সুন্দরবন (খুলনা)
  • কৃষি রেডিও (পটুয়াখালী)
  • রেডিও মেঘনা (ভোলা)
  • রেডিও-পল্লীকণ্ঠ (মৌলভীবাজার)
  • রেডিও সাগরদ্বীপ (নোয়াখালী)
  • রেডিও-সাগরগিরি (চট্টগ্রাম)
  • রেডিও নাফ (কক্সবাজার)
  • রেডিও-ঝিনুক (ঝিনাইদহ)
  • রেডিও বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ)

মূলত, এমন সব এলাকায় কমিউনিটি রেডিওর কার্যক্রম চলে যেখানে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেতারের ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়া যায় না।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্র্রাসে কমিউনিটি রেডিও

পাঁচ থেকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়ার পর যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন কমিউনিটি রেডিও-ই হয়ে ওঠে মানুষের একমাত্র ভরসা।

বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকেই সার্বক্ষণিক সতর্কবার্তা ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রচার করেছে কমিউনিটি রেডিওগুলো।

আর ঘূর্ণিঝড় আম্পান যেহেতু এই ঝড় করোনা মহামারির সময়ে এসেছে, তাই আবহাওয়া বার্তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বার্তাও প্রচার করা হয়েছে।

প্রচার করা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনাও। ফলে মানুষ সময়মতো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে পেরেছেন। বেঁচে গেছে অনেক মানুষের প্রাণ, কমেছে সম্পদের ক্ষতি।

আগে এসব মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত সম্পর্কে জানতে পারতেন না। বাতাসের অবস্থা দেখে পরিস্থিতি বুঝতেন।

ততক্ষণে ঝড় চলে আসতো। কিন্তু, এখন সাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রচার করতে শুরু করে কমিউনিটি রেডিও।

সতর্কবার্তাগুলো স্থানীয় ভাষায় খুব সহজ করে প্রচার করা হয়। বলে দেয়া হয়— কখন, কী করতে হবে। মানুষও ফোন করে জেনে নেন অনেক তথ্য।

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, রোয়ানু, মোরা ও বুলবুলের সময়ও একইভাবে কাজ করেছে তারা।

আট থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়ার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক অনুষ্ঠান সার্বক্ষণিক চলতে থাকে।

ঝড়ের পরেও কোথায়-কী ক্ষতি হয়েছে, কোথায় ত্রাণ পাওয়া যাবে, পানি বিশুদ্ধ করার উপায়সহ নানা বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।

করোনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন

কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় কমিউনিটি রেডিওগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

করোনার প্রকোপ কমিয়ে আনতে গ্রামীণ জনগণকে মহামারীর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত ও সচেতন করা, নাগরিক সমাজের সংগঠনসমূহ, সরকার, স্বাস্থ্য কর্মীদের এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

জনগণের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখা এবং স্থানীয় বাজার, নাগরিক সমাজের সংগঠন এবং সরকারে মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে কমিউনিটি রেডিওগুলো ভূমিকা পালন করছে।

নীতিমালা

কোনো নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠী তা শহরতলী, গ্রাম, পাহাড়ি অঞ্চল, দ্বীপ, উপজেলার জন্য হবে কমিউনিটি রেডিও।

সেই অঞ্চলের মানুষের বোধগম্যের জন্য আঞ্চলিক ভাষায় এর অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে।

অনুষ্ঠানসমূহ এমনভাবে পরিকল্পিত হবে যাতে তাদের আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়, এমনকি তারা যে সব বিষয়ে বিনোদন পেতে অভ্যস্ত যেমন পল্লীসঙ্গীত, যাত্রা, পুঁথিপাঠ, গল্প, কাহিনীর আসর ইত্যাদিই প্রাচ্যের প্রাধান্য হবে।

এজন্য বাংলাদেশ সরকার কমিউনিটি রেডিওর সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। নিম্নে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

  • কমিউনিটি রেডিও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে অবশ্যই অলাভজনক হতে হবে।
  • কম্যুনিটি রেডিও’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কমপক্ষে পাঁচ বছর কমিউনিটি পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা অবশ্যই থাকতে হবে।
  • কমিউনিটি রেডিও স্টেশনকে অবশ্যই নিশ্চিত ও সুনির্দিষ্টভাবে কমিউনিটির লোকজনকে সেবা প্রদান করতে হবে।
  • সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ধ্যান-ধারনার প্রতিফলন সমৃদ্ধ একটি পরিচালনা পরিষদ থাকবে।
  • সম্প্রচার অনুষ্ঠানসূচীতে কমিউনিটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজ, নারীর অধিকার, গ্রামীণ ও এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন, পরিবেশ, আবহাওয়া ও সাংস্কৃতিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এবং এতে অবশ্যই জনগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা থাকতে হবে।
  • সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের আইনগত ভৈধতা থাকতে হবে এবং সম্প্রচারের পরীক্ষামূলক সম্প্রচার পর্বে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মূলধারার গণমাধ্যমের সুযোগ এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার লাভ করবে।
  • বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের সুযোগ পেল কমিউনিটি রেডিও কমিউনিটি রেডিওগুলোর মোট প্রচার সময়ের ১০ শতাংশ বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ রেখে কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনার সংশোধিত নীতিমালা জারি করেছে সরকার।

তথ্য মন্ত্রণালয় ‘কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা-২০১৭’ জারি করেছে।

টিকে থাকার জন্য শুরু থেকেই আয়ের উৎস হিসেবে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচারের দাবি জানিয়ে আসছিল কমিউনিটি রেডিওগুলো।

‘কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০০৮’ এ বলা হয়েছে, ‘কমিউনিটি রেডিওতে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক বিষয় সম্প্রচার, সব ধরনের নির্বাচনী প্রচার ও বিজ্ঞাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।’

নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় নির্বাহের জন্য দৈনিক মোট প্রচার সময়ের সর্বোচ্চ শতকরা ১০ ভাগ সময় বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে।

একই সঙ্গে কমিউনিটি রেডিওগুলোর লাইসেন্স দেয়া ও তদারকি প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়েছে নতুন নীতিমালায়।

নীতিমালার শর্ত ভঙ্গে লাইসেন্স স্থগিত ও বাতিলের মতো শাস্তিও রয়েছে।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগের নীতিমালাটি ছিল ২০০৮ সালের। ১০ বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে।

আমরা দেখেছি কিছু বিজ্ঞাপন প্রচার করতে না দিলে তাদের ফাইন্যান্সিয়ালি টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

তাই নতুন নীতিমালায় কিছু সুযোগ তাদের আমরা দিয়েছি।

তিনি বলেন, ‘আমরা স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে নীতিমালাটি যতটুকু সংশোধন করা যায় ততটুকুই করেছি।

তবে নীতিমালায় বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্তও দেয়া হয়েছে।

সেগুলো হচ্ছে- বিজ্ঞাপন উন্নয়ন ও জনসচেতনতামূলক হতে হবে এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, বিভিন্ন ধর্ম বা ধর্মমতাবলম্বীদের মধ্যে বিদ্বেষ বা বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে এমন অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না, অর্থায়নকারীরা সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান বা অনুষ্ঠানমালার বিষয়বস্তু কিংবা স্টাইল এবং স্টেশনের নীতিমালার ব্যাপারে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না এবং বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান নির্দেশনা ও জারি করা আইন/বিধি/নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে।

সংশোধিত নীতিমালায় যা কিছু নতুন

কমিউনিটি রেডিওকম্যুনিটি রেডিওর ধারণায় বলা হয়েছে- এটি হচ্ছে কল্যাণমূলক সম্প্রচার মাধ্যম যার মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় থাকে তৃণমূল পর্যায়ের জনগোষ্ঠী। মূলত অলাভজনক ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।

এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কমিউনিটিকে সেবা দেয়া এবং স্থানীয় লোকজ, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন-বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দেয়া।

প্রান্তিক এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কম্যুনিটি রেডিও স্থাপনে অগ্রাধিকার পাবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাময়িক লাইসেন্স পাওয়ার এক বছরের মধ্যে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

না পারলে লাইসেন্স বাতিল হবে। তবে সরকার যুক্তিসঙ্গত মনে করলে এ সময়-সীমা বৃদ্ধি করতে পারবে।

রেডিও স্টেশন স্থাপনের পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পরীক্ষামূলক সম্প্রচার কার্যক্রম চালু করতে হবে।

ব্যর্থ হলে সরকার জামানত বাজেয়াপ্তসহ লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। আগের নীতিমালায় এ ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল না।

চূড়ান্ত লাইসেন্স প্রাপ্তির পর কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সরকারের অনুমোদনে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সর্বোচ্চ আরও দুটি কম্যুনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

আগের নীতিমালায় দুই বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেখানে লাইসেন্স নবায়ন ফি’র বিষয়ে কিছু বলা ছিল না।

নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতি অর্থবছরের জন্য লাইসেন্স নবায়ন ফি ১০ হাজার টাকা।

প্রতি অর্থবছর শেষ হওয়ার ৩০ দিন আগে নবায়নের জন্য আবেদন করতে হবে এবং কোনো কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করতে ব্যর্থ হলে ৩ হাজার সারচার্জ পরিশোধ করে পরবর্তী অর্থ বছরে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।

সরকার প্রয়োজনে এ সারচার্জ পুননির্ধারণ করতে পারবে। কোনো সংস্থা বা এলাকার নামে রেডিও স্টেশনের নামকরণ করা যাবে না।

লাইসেন্স বা চুক্তি সংক্রান্ত সরকারের কোনো পাওনা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে, বিটিআরসির তরঙ্গ বরাদ্দপত্রের যে কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে এবং এ নীতিমালার কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে সরকার কম্যুনিটি রেডিওর লাইসেন্স স্থগিত ও বাতিল করতে পারবে।

আগের নীতিমালায় এ ধরনের নিয়ম ছিল না।

প্রত্যেকটি কম্যুনিটি রেডিও স্টেশনের সম্প্রচারের ব্যাপ্তি হবে এর অবস্থানকে কেন্দ্র করে চতুর্দিকে ২৫ কিলোমিটার।

এজন্য সর্বোচ্চ ২৫০ ওয়াট সম্প্রচার শক্তির ট্রান্সমিটার ব্যবহার করা যাবে।

আগের নীতিমালায় চতুর্দিকে ব্যাপ্তি ছিল ১৭ কিলোমিটার। আর ট্রান্সমিটারের শক্তি ছিল ১০০ ওয়াট।

নতুন নীতিমালা অনুযায়ী কম্যুনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনার জন্য তথ্য সচিবের নেতৃত্বে জাতীয় রেগুলেটরি কমিটি গঠন করা হবে।

বেতারের প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে গঠন করা হবে ‘কারিগরি উপ-কমিটি’। এই কমিটি জাতীয় রেগুলেটরি কমিটির নিয়ন্ত্রণাধীন হবে।

বেতারের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে থাকবে কেন্দ্রীয় মনিটরিং কমিটি। আর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হবেন স্থানীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি।

ভৌগলিক অঞ্চলের ভিত্তিতে সারাদেশে কম্যুনিটি রেডিওগুলোর মধ্যে দু’টি অ্যালায়েন্স বা নেটওয়ার্ক গঠিত হতে যাচ্ছে।

একটি দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত কম্যুনিটি রেডিও গুলো এবং অপরটি দেশের উপকূলীয় কমিউনিটি রেডিওগুলোকে নিয়ে।

এর ফলে কম্যুনিটি রেডিওর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ আরও বাড়বে এবং রেডিওতে জনঅংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মতামত দিন