ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা: ‘তর্কহীন ভাবে সর্বকালের সেরা’

Posted by

ম্যারাডোনা মানে অন্তহীন বিতর্ক। ৮৬’র বিশ্বকাপের আসরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা তার একটি গোলকে ‘হ্যান্ড অব গড গোল’ এবং আরেকটিকে ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

ম্যারাডোনা

ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা ওরফে দিয়েগো মারাদোনা। যিনি প্রায় একা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছিলেন আর্জেন্টিনাকে।

১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের বস্তিতে তার জন্ম ম্যারাডোনার। জায়গাটার নাম ভিলা ফিয়োরিতো। মৃত্যু ২৫ নভেম্বর ২০২০। তিগ্রে-তে নিজ বাসায় মারা যান মারাদোনা।

মৃত্যুর সময় আর্জেন্টাইন এই কিংবদন্তির বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।

যার প্রতিটি কথা ও কাজ শিরোনাম হয় সংবাদ মাধ্যমে। ফুটবলের ঈশ্বর নামেও পরিচিত তিনি।

হ্যান্ড অফ গড গোলের বিতর্ক সত্ত্বেও ৮৬’র মেক্সিকো বিশ্বকাপে তার ফুটবল-প্রেমে পাগল হয়েছিল অনুসারীরা।

ইতালির নাপোলিকে আঁস্তাকুড় থেকে তুলে সিরি-আ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন।

নব্বইয়ের বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন তিনি। জেতাতে পারেননি।

রুডি ফোলারের বিতর্কিত ফাউলে পেনাল্টি পেয়ে ১-০ গোলে জিতেছিল পশ্চিম জার্মানি। খেলেছিলেন ৯৪ বিশ্বকাপেও।

কিন্তু সেই টুর্নামেন্টে এসে এলোমেলো হয়ে যান ম্যারাডোনা।

দুটি ম্যাচ খেলার পর ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে বলেছিলেন, ‘ওরা আমার পা কেটে নিয়েছে।’ ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আবার মাঠে ফিরেছিলেন।

কিন্তু আগের মারাদোনাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ছোটবেলার ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে কিছুদিন খেলে বুটজোড়া তুলে রাখেন। তারপর কোকেনের নেশায় ডুবে থাকতেন।

এমন অবস্থা হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত রিহ্যাবে যেতে হয়।বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবাতে গিয়ে নেশামুক্ত হন।

উঠে আসা

বুয়েন্স আয়ার্সের বস্তি থেকে আক্ষরিক অর্থেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ফুটবল তাকে সেই সাহস দিয়েছিল। মাত্র ৮ বছর বয়সে তাকে আবিষ্কার করেন ফ্রান্সিসকো কর্নেজো।

জুনিয়র দলের কোচ হিসেবে তিনি তখন সারা দেশ ঘুরে প্রতিভা খুঁজছেন।

খুদে মারাদোনাকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পরে বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টিনা জুনিয়র দলের জন্য ট্রায়াল দিতে এসেছিল মারাদোনা।

দক্ষতা দেখে মনে হয়নি এ ছেলের বয়স মাত্র ৮। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিচয়পত্র দেখতে চাইলাম।

সে কিছু দেখাতে পারেনি। তার ছোট্ট গড়ন দেখে অবশ্য মনে হয়েছিল মিথ্যা বলছে না।

যদিও সে খেলছিল প্রাপ্তবয়স্কদের মতো। যা দেখে আমরা ওর ভক্ত হয়ে গেলাম।’

সেটা ১৯৬৮ সাল। ৮ বছর পর আর্জেন্টিনা জুনিয়র দলে অভিষেক ম্যারাডোনার।

১৯৭৭-এ জাতীয় দলে পা রাখেন। নিজেদের দেশে ১৯৭৮-র বিশ্বকাপ দলে তাকে নেওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।

বলা হয়ে থাকে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ড্যানিয়েলে প্যাসারেলা ও কোচ সেজার মেনোত্তি বয়স কম বলে মারাদোনাকে দলে নেননি।

ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ অভিষেক ’৮২-তে। ইতালি ও ব্রাজিলের কাছে হেরে বাদ পড়ে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই।

মারাদোনা কিছু করতে পারেননি। সব জমিয়ে রেখেছিলেন মেক্সিকোর জন্য। ছিয়াশির বিশ্বকাপেই তিনি মারাদোনা হয়ে ওঠেন।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল দিয়ে। এরপর করেন শতাব্দী সেরা গোল।

ইংল্যান্ড ছিটকে গিয়েছিল। তার আগে মারাদোনার পায়ের জাদুতে সর্বনাশ হয়েছিল বেলজিয়ামের।

ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির সর্বনাশের মূলেও ছিল তার দুটি পা।

আত্মজীবনীতে ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ জয়ের বর্ণনায় লিখেছিলেন, ‘অতিরিক্ত সময়ে জার্মানির অবসন্ন পাগুলো দেখে ভরসা পেয়ে সেন্টার স্পটে বল বসিয়ে সবাইকে চিৎকার করে বলেছিলাম, জিতব আমরাই।

জিততেই হবে, ওরা আর পারছে না, শেষ চেষ্টা আর একবার, অতিরিক্ত সময়ের আগেই শেষ করব। নিজেদের অর্ধেই ছিলাম।

মাথা তুলে দেখতে পাই বুরুচাগার সামনে সেই রাস্তা যেখান দিয়ে চলতে চলতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হব। নিরাশ করেনি বুরু। ৬ মিনিট বাকি তখনো।

বিলার্দো চেঁচাচ্ছে, ডিয়েগো, ভালদানো, নেমে এসো, মার্ক করো। কোথায় কী। নামছিলাম ঠিকই, কিন্তু জানতাম, আর হবে না।

রোমুয়ালদো আরপি ফিলোর বাঁশি, আর্জেন্টিনীয়দের উল্লাস আর আমার কেঁদে ফেলা- সব একসঙ্গে।’

গতকয়েক দিনে গৌরবের সেই কান্না থেকে আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বর হয়ে ওঠেন ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা, যার সুস্থতা কামনায় দিনরাত এক করে ফেলেন দেশটির মানুষ।

সেই ম্যারাডোনাই বুধবার চলে গেলেন হঠাৎ করে। চলে গেলেন কিন্তু একজন ম্যারাডোনা বেঁচে থাকবেন ততদিন, যতদিন ফুটবল থাকবে।

ইউরোপে ম্যারাডোনা

১৯৮২ বিশ্বকাপের পর ৫ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফিতে বার্সেলোনায় যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে কোচ সিজার লুইস মেনত্তির অধীনে বার্সেলোনা রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে এবং অ্যাথলেটিক বিলবাওকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপ জেতে।

তবে, বার্সায় ম্যারাডোনা কিছুটা খারাপ সময় কাটিয়েছেন। প্রথমে তাকে হেপাটাইটিসের সাথে লড়তে হয়।

এরপর গোড়ালির ইনজুরিতে পড়েন। অবশ্য, চিকিত্‍সা শেষে দ্রুতই মাঠে ফেরেন। বার্সেলোনার হয়ে ৫৮ খেলায় ৩৮টি গোল করেন।

বার্সেলোনায় থাকাকালে ক্লাব পরিচালকদের সাথে দফায় দফায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন ম্যারাডোনা; বিশেষ করে ক্লাব প্রেসিডেন্ট ইয়োসেপ লুইস নুনেজের সাথে।

১৯৮৪ সালে আরেকটি রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে (৬.৯ মিলিয়ন ইউরো) সিরি এ ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন তিনি।

তার যাদুর ছোয়ায় অখ্যাত নাপোলিকে চেনে সারা দুনিয়া

১৯৮৫ সালে নাপোলির হয়ে মাঠে নামেন। এই ক্লাবেই ম্যারাডোনা তার পেশাদার ক্যারিয়ারের শিখরে পৌঁছান।

খুব দ্রুত ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার যাদুতে নাপোলিও নাপোলিও তার ইতিহাসের সেরা সময় কাটায় তখন।

ম্যারাডোনার অধীনে ১৯৮৬–৮৭ ও ১৯৮৯–৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে এবং ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানারআপ হয়।

তার সময়ে নাপোলি একবার কোপা ইতালিয়া (১৯৮৭) জেতে এবং একবার রানার-আপ (১৯৮৯) হয়।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপও জেতে নাপোলি। ১৯৮৭–৮৮ মৌসুমের সিরি এ-তে মারাদোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।

ইতালিতে বিভিন্ন ব্যক্তিগত সমস্যায় জড়ায় ম্যারাডোনা। তার কোকেইন নেশা বহাল থাকে।

অনুশীলনে অনুপস্থিত থাকায় ক্লাবের পক্ষ হতে তাকে ৭০,০০০ মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়। ইতালিতে তাকে পুত্রসন্তান সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হতে হয়।

এরপর ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ১৯৯২ সালে মারাদোনা নাপোলি ছেড়ে দেন।

তবে ম্যারাডোনা নাপোলির কাছে আজও সম্মানিত। নাপোলিতে তার অর্জনসমূহের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ক্লাবের ১০ নম্বর জার্সিটি দাপ্তরিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ এবং ফরাসি ক্লাব অলিম্পিকে মার্শেই ম্যারাডোনাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহী হলেও স্পেনের ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেন তিনি। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন।

১৯৯৩ সালে তিনি লিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেন এবং ১৯৯৫ সালে তিনি বোকা জুনিয়র্সে ফিরে আসেন এবং সেখানে দুই বছর খেলেন।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কিছু আগে ম্যারাডোনা টটেনহাম হটস্পারের হয়েও মাঠে নামেন ইন্টারন্যাজিওনালের বিপক্ষে।

খেলায় টটেনহাম ২–১ গোলে জয় লাভ করে। তিনি গ্লেন হোডেলের সাথে খেলেন, যিনি ম্যারাডোনার জন্য তার ১০ নম্বর জার্সিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপ জেতানোর পাশাপাশি ১৯৯০ বিশ্বকাপে রানার আপ করেন ম্যারাডোনা।

১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার।

১৯৭৯ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ফিফা বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন।

প্রতিযোগিতার ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩–১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।

১৯৭৯ সালের ২ জুন স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম গোল করেন মারাদোনা। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ফিফা অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ (১৯৭৯) ও ফিফা বিশ্বকাপ (১৯৮৬) উভয় প্রতিযোগিতায় গোল্ডেন বল জিতেছেন।

চারটি বিশ্বকাপে (১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০ এবং ১৯৯৪) আর্জেন্টিনার হয়ে টানা ২১টি খেলায় মাঠে নামেন মারাদোনা।

১৬টি খেলায় জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নেমেছেন, যা একটি বিশ্বকাপ-রেকর্ড।

বিশ্বকাপের ২১টি খেলায় ৮টি গোল করেন এবং অন্য ৮টি গোলে সহায়তা করেন। যার মধ্যে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে করেন ৫টি গোল এবং ৫টি সহায়তা।

খেলোয়াড় জীবনের পরবর্তী সময়ে কোচ হিসেবে আর্জেন্টিনা দলের দায়িত্ব নেন ম্যারাডোনা। তবে কোচিংয়ে ততটা সফল হতে পারেননি ফুটবলের এ জাদুকর।

ম্যারাডোনার সেরা ৫ গোল

ফুটবল মাঠে ডিয়াগো ম্যারাডোনা ছিলেন একজন শিল্পী। গতি আর বাঁ পায়ের কারিকুরিতে উপহার দিয়েছেন জাদুকরী শত মুহূর্ত।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড লড়াইয়ে ম্যারাডোনার দুই গোল স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

একটি পরিচিত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল নামে, ‘অন্যটি গোল অব দা সেঞ্চুরি।’

সেই আসরেই বেলজিয়ামের বিপক্ষে দ্বিতীয় গোল এবং এর আগের বছর নাপোলির হয়ে দুটি গোল জায়গা পেয়েছে এই তালিকায়।

‘হ্যান্ড অব গড’ গোল : ১৯৮৬ বিশ্বকাপে, মেক্সিকো সিটিতে ২২ জুনের সেই ম্যাচে গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধে গতিপথ পাল্টে দেন ম্যারাডোনা।

৬ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের চেয়ে ৮ ইঞ্চি খাটো হলেও মারাদোনাই পান বলের নাগাল। বাঁ হাত বাড়িয়ে হেডের ভঙ্গিমায় খুঁজে নেন জাল।

শিলটনসহ ইংলিশ খেলোয়াড়রা হ্যান্ডবলের দাবি জানাতে থাকলেও এতে সাড়া দেননি রেফারি আলি বিন নাসের।

তিনি বুঝতেই পারেননি, মারাদোনা মাথার জায়গায় হাত দিয়ে গোল করেছেন।

ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ম্যারাডোনা জানান, কিছুটা ম্যারাডোনার মাথা আর কিছুটা ঈশ্বরের হাতের সহায়তায় এসেছে এই গোল। সেই থেকে এই গোল ফুটবলের গল্প-গাঁথায় পরিচিত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল নামে।

দা গোল অব দা সেঞ্চুরি : মিডফিল্ডার এক্তর এনরিকে নিজেদের অর্ধে পাস দিয়েছিলেন ম্যারাডোনাকে। ১০ সেকেন্ড স্থায়ী, ৬০ গজের জাদুকরী এক দৌড়ের গল্প। পিটার বেয়ার্ডসলে, টেরি বুচার (দুইবার), পিটার রিড, টেরি ফেনউইককে পেরিয়ে যান তিনি।

ছুটে এসেছিলেন গোলরক্ষক, তাকেও কাটিয়ে ফাঁকা জালে বল পাঠান ম্যারাডোনা, ২-০ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা।

শেষ পর্যন্ত ২-১ এ জিতে তারা যায় সেমি-ফাইনালে। পরে এই গোল নিয়ে ম্যারাডোনা জানান, তিনি আসলে ভালদানোকে পাস দিতে চেয়েছিলেন।

এক নজরে ডিয়াগো ম্যারাডোনা

  • ১৯৬০: ৩০ অক্টোবর বুয়েনস আইরেস প্রদেশের লেনাস জেলায় জন্ম।
  • ১৯৭৬: স্থানীয় ক্লাবের হয়ে খেলোয়াড়ি জীবনের অভিষেক।
  • ১৯৭৭: ২৭ ফেব্রুয়ারি আর্জেন্টিনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে মাঠে নামেন। তখন তার বয়স ১৬ বছর ১২০ দিন।
  • ১৯৭৮: বয়সে কম হওয়ার কারণে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়েন।
  • ১৯৭৯: ২ জুন, জাপানে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক গোল করেন। অধিনায়ক হিসেবে শিরোপাও জয় করেন।
  • ১৯৮২: ২১ বছর বয়সে দলের সঙ্গে ইউরোপে পাড়ি জমান স্পেনে বিশ্বকাপ খেলার জন্য। ব্রাজিলের কাছে ৩-১ গোলে হেরে আর্জেন্টিনা বিদায় নেয়।
  • ১৯৮৪: ইতালীয় ক্লাব নেপোলিতে যোগ দিলেন। ৪.৬৮ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে।
  • ১৯৮৬: ঈশ্বরের হাতের খ্যাতি আর সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে আর্জেন্টিনাকে এনে দেন বিশ্বকাপ। ওই বছরই ইউরোপের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পান।
  • ১৯৮৭: নেপোলিকে জেতান ইতালীয় ফুটবলের শিরোপা।
  • ১৯৯০: সন্তানের পিতৃত্ব সংক্রান্ত মামলায় জরিমানা। বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে ০-১ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা।
  • ১৯৯১: ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হওয়ার কারণে ইতালি ত্যাগ করতে হয়। কোকেন গ্রহণের অভিযোগে আর্জেন্টিনায় গ্রেফতার হন।
  • ১৯৯২: স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়াট ফুটবল ক্লাবে যোগ দেন। কিন্তু আশানুরূপ ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি।
  • ১৯৯৩: সেভিইয়া ছেড়ে আবারও আর্জেন্টিনায় ফিরে আসেন। যোগ দেন স্থানীয় নোয়েল ওল্ড বয়েজ দলে।
  • ১৯৯৪: আবার ড্রাগ টেস্টে ব্যর্থ হলে এক ম্যাচ পরেই বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়েন। এরপর আর জাতীয় দলে খেলেননি।
  • ১৯৯৬: মাদকাসক্তি থেকে মুক্তিলাভের জন্য ক্লিনিকে ভর্তি হন।
  • ১৯৯৭: ৩৭ বছর বয়সে অবসর নেন।
  • ২০০০: হৃদযন্ত্রের সমস্যায় উরুগুয়ের এক হাসপাতালে ভর্তি হন।
  • ২০০২: মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি লাভের আশায় কিউবাতে চলে যান।
  • ২০০৩: ম্যারাডোনা তার ছেলের সঙ্গে দেখা করেন প্রথমবারের মতো। এর আগে তিনি সবসময় তাকে পুত্র হিসেবে অস্বীকার করে আসছিলেন।
  • ২০০৪: ১৯ এপ্রিল আরেকবার গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
  • ২০০৮: আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ঘোষণা করে ডিসেম্বর ২০১০ থেকে আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ম্যারাডোনা।
  • ২০১০: জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে পদত্যাগ করেন।
  • ২০১১: আরব আমিরাতের আল ওয়াসেল ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

কিন্তু তাকে ঘিরে রেখেছিল ইংলিশ ফুটবলাররা। একটু জায়গার সন্ধানে পায়ের কারিকুরি উৎস সেই গোলের।

সেমি-ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে দ্বিতীয় গোল : বিশ্বকাপের ওই আসরেই কোয়ার্টার-ফাইনালের মতো সেমি-ফাইনালেও আর্জেন্টিনার জয়ের নায়ক ম্যারাডোনা। বেলজিয়ামের বিপক্ষেও তিনি করেছিলেন জোড়া গোল।

৫১তম মিনিটে দলকে এগিয়ে নেওয়ার পর ৬৩তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন তিনি। এই গোল নিয়েও চর্চা কম হয়নি। ছয় সেকেন্ডে ছয়টি স্পর্শ, একটি ছিল তার দুর্বল ডান পায়ের।

সপ্তম স্পর্শটি ভেঙে দেয় বেলজিয়ামের বিশ্‌কাপ স্বপ্ন।

জুভেন্টাসের বিপক্ষে দুর্দান্ত ফ্রি-কিক : ১৯৮৫ সালে ঘরের মাঠে জুভেন্টাসের বিপক্ষে ফ্রি কিকে দুর্দান্ত এক গোলে নাপোলিবাসীর হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা পেয়ে যান ম্যারাডোনা।

সেই সময়ের ইউরোপ চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে নাপোলিকে জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি।

মিশেল প্লাতিনির দলের বিপক্ষে ডি-বক্সের ভেতরে একটি ইন ডাইরেক্ট ফ্রি কিক পায় নাপোলি। বলা হয়ে থাকে জুভেন্টাসের খেলোয়াড়দের গড়া দেওয়াল খুব কাছে থাকলেও সতীর্থ মিডফিল্ডার এরালদো পেস্সিকে বল তার দিকে গড়িয়ে দিতে বলেছিলেন ম্যারাডোনা।

তা-ই করেন পেস্সি। বাকিটুকু যেন ইতিহাস।

ওই টুকু জায়গার মধ্যে জুভেন্টাসের খেলোয়াড়দের মাথার উপর দিয়ে বল জালে পাঠান ম্যারাডোনা। স্রেফ এক পা এগিয়ে এতো নিখুঁত এবং গতিময় শট! কিছুই করার ছিল না গোলরক্ষকের।

ভেরোনার বিপক্ষে দূরপাল্লার শটে গোল : ম্যারাডোনার শটের গতি আর নিখুঁত লক্ষ্যের আরেকটি প্রামাণ্য এই গোল। জালের দেখা পেতে সব সময় জমাট রক্ষণ ভাঙতে হয়নি তাকে। পেরিয়ে যেতে হয়নি ডিফেন্ডারদের।

ডি-বক্সের বাইরে থেকেও খুঁজে নিয়েছেন ঠিকানা। ১৯৮৫ সালে ভেরোনার বিপক্ষে নাপোলির এই প্লে মেকারের প্রথম স্পর্শটা ছিল দুর্দান্ত।

উঁচু করে নিজেদের অর্ধ থেকে বাড়ানো বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ঘুরে দারুণ ভলিতে পাঠান জালে। খুব একটা এগিয়ে ছিলেন না গোলরক্ষক; কিন্তু কাছের বার ঘেঁষে যাওয়া বল ঠেকানোর চেষ্টাও করতে পারেননি তিনি।

ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা

ফুটবল ঈশ্বরশুরুতে তার ক্যারিয়ারের উত্থান। বোকাকে আর্জেন্টাইন শিরোপা জিতিয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সেই কাতালান জায়ান্ট বার্সেলোনায় পাড়ি জমান ম্যারাডোনা। এরপর মাত্র ২৫ বছর বয়সে অনেকটা একক প্রচেষ্টায় আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জেতান।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে তার প্রতিভা আর তার উল্টো দিকটা প্রকাশ পায়।

ইংলিশদের বিপক্ষে ওই ম্যাচে হাত দিয়ে গোল করেন তিনি, যেটাকে তিনি নিজেই ‘হ্যান্ড অব গড’ বলে অভিহিত করেন।

একই ম্যাচে ঝড়ের গতিতে ৬০ মিটার দূর থেকে দৌড়ে ইংলিশদের পাঁচ ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলটি করেন।

২০০২ সালে ফিফা ডট কম এর ভোটাররা গোলটিকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসাবে নির্বাচিত করে।

বিশ্বকাপ জিতিয়ে দেশে ফেরার পর তাকে আর্জেন্টাইনরা ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করা শুরু করেন। এমনকি তার ভক্তদের একটা অংশ ‘চার্চ অব ম্যারাডোনা’ প্রতিষ্ঠা তার আরাধনাও শুরু করেন।

এক বছর পর ইতালির নাপোলিকে প্রথমবারের মতো সিরি আ’র শিরোপা জেতান ম্যারাডোনা। তিন বছর পর আবারও নাপোলিকে শিরোপা স্বাদ দেন তিনি।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

ইতালির ওই শহরেও তাকে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করা শুরু হয়। সেখানেও তার নামে চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন একদল ভক্ত। কিন্তু ততদিনে তার অধঃপতন শুরু হয়ে গেছে।

‘হ্যান্ড অব গড’ নিয়ে বিবিসিকে যা বলেছিলেন ম্যারাডোনা

বিশ্ব ফুটবলে গোলটি খ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডিয়েগো ম্যারাডোনার সেই ‘হ্যান্ড অব গড’ ফুটবলের আজীবনের বিতর্ক।

তবে এই বিতর্ক পাশ কাটিয়ে ওই বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টিনা। সেই গোল নিয়ে ২০০৬ সালে বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।

মৃত্যু

ডিয়েগো ম্যারাডোনা২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর  হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০।

মৃত্যুর সময়ও তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার ঘরোয়া ক্লাব জিমনাসিয়া ডি লা প্লাটার কোচ।

গত ৩০ অক্টোবর ৬০তম জন্মদিন উদযাপন করেন ম্যারাডোনা। তার কয়েক দিন পর নভেম্বরের শুরুর দিকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন সর্বকালের সেরা ফুটবলার। তার মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধেছিল।

চিকিৎসকরা দাবি করেছিলেন, ম্যারাডোনার মস্তিষ্কে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ পর বুধবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের জন্য পৃথিবীকে বিদায় জানালেন নন্দিত ফুটবলার। শোকসাগরে ভাসালেন অগণিত ভক্ত-অনুরাগীকে।

তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ফুটবলবিশ্ব। একের এক আসছে শোকবার্তা। কিংবদন্তি ফুটবলারকে শ্রদ্ধা জানানোর পালা চলছে। অনেকের মতে, তিনিই বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার।

আকাশে একসঙ্গে ফুটবল খেলব- পেলে

পেলেপেলে নাকি মারাদোনা, সর্বকালের সেরা কে? ফুটবল যত দিন থাকবে, তত দিন এই তর্ক চলবে।

কিন্তু ‘রাজা’ এবং ‘ঈশ্বর’-এর সম্পর্ক যে এ সবের ঊর্ধ্বে, মারাদোনা-বিয়োগে কাতর হয়েও তা জানাতে ভুললেন না পেলে।

মারাদোনার মৃত্যুর খবর পেয়ে এ দিন নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ট্রফি হাতে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তির একটি ছবি পোস্ট করে পেলে লেখেন, ‘অত্যন্ত বেদনাদায়ক খবর।

এক জন প্রিয় বন্ধুকে হারালাম। অনেক কিছু বলার রয়েছে।

কিন্তু এই দুঃসময়ে ঈশ্বর ওঁর পরিবারকে শক্তি দিন। আশা করি এক দিন আকাশে ফুটবল খেলব আমরা’।

মতামত দিন