হালদা নদী: এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র

Posted by

হালদা নদী, এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার এ নদী; প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি

হালদা নদী

বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় ৮০০ নদীর মধ্যে দেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার ছোট্ট একটি নদী হালদা।

নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। হালদা পরিচিতি নম্বর পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী নং ১৬।

নামে-গুণে অনন্য ‘হালদা’ স্মরণাতীতকাল থেকে রুই, কাতলা, মৃগেলও কালিবাউশ ডিম ছেড়ে আসছে।

তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, নদী থেকে পোনা আহরণের নজির থাকলেও হালদা ছাড়া বিশ্বের আর কোনো নদীতে ডিম আহরণের নজির নেই।

প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি ‘হালদা নদী’- বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী এবং এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।

হালদা’র উৎপত্তি স্থল খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদা।

সালদার পাহাড়ি র্ঝণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে নামকরণ হয় হালদা।

‘হালদা নদী’ বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বাটনাতলী পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে মানিকছড়ি, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িশ্চরের নিকট কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে।

হালদার প্রধান উপনদী ধুরুং খুবই খরস্রোতা। এটি পার্বত্য এলাকার পাকশমিমুরা রেঞ্জ থেকে বের হয়ে পূর্বদিকে হালদা নদীর প্রায় সমান্তরালে সমগ্র ফটিকছড়ি উপজেলা ঘুরে পূর্ব ধলাই নামক স্থানে হালদা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

গত এক শতাব্দীর মধ্যে নদীটি বেশ কয়েকবার গতিপথ পরিবর্তন করেছে।

হালদা নদী ‘তে মাছের ডিম ছাড়ার রহস্য!

রহস্যময় এ পৃথিবীতে হালদা নদীও অপার এক রহস্যে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে প্রতিবছর বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে কার্পজাতীয় মাছ ডিম দিয়ে থাকে।

কিন্তু কেন বা কি কারণে কার্পজাতীয় মাছ হালদায় ডিম দেয় তা আমাদের অনেকেরই অজানা।

আসুন হালদার কিছু রহস্যময় তথ্য জেনে আসি-

হালদা নদীর কিছু ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যই এই নদীকে করে তুলছে মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী। ভৌত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এই নদীর অনেকগুলো বাঁক যেগুলোকে “অক্সবো” (Ox-bow) বাঁক বলে।

এই বাঁকগুলোতে স্রোতের ফলে প্রচণ্ড ঘূর্ণন সৃষ্টি হয় যা গভীর স্থানের সৃষ্টি করে।

স্থানীয় ভাষায় গভীর স্থানগুলোকে “কুম” বা “কুয়া” বলা হয়। উজান হতে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ কুমের মধ্যে এসে জমা হয় ফলে পানি ফেনিল ও ঘোলাটে হয়ে যায়। মা মাছেরা কুমের মধ্যে আশ্রয় নেয়।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

তাছাড়া এক গবেষণায় দেখা গেছে হালদা নদীর গভীরতা ও গঠন এমন যে কিছু কিছু স্থানে পানির চতুর্মুখী বা ত্রিমুখী ঘূর্ণন এর সৃষ্টি হয় যেগুলোকে ভর্টেক্স জোন (Vortex zone) বলা হয়।

এই ঘূর্ণনের ফলে হালদা নদীতে বহুমুখী স্রোতের সৃষ্টি হয় যা মাছকে ডিম পাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এইরকম বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আর কোন নদীতে পাওয়া যায়না।

অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ী ঝর্ণা বা ছড়া এবং প্রতিটি পতিত ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোত এবং অতি ঘোলাত্ব।

অনেকগুলো পাহাড়ী ঝর্ণা বিধৌত পানি প্রচুর জৈব উপাদান এবং ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান নদীতে বয়ে আনে যার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়।

এইসব পুষ্টি উপাদান মাছের প্রজনন পূর্ব গোনাডের পরিপক্কতায় সাহায্য করে।

রাসায়নিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কম কন্ডাক্টিভিটি, সহনশীল দ্রবীভুত অক্সিজেন, সহনশীল অম্লত্ব ও ক্ষারকত্ব ইত্যাদি
মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে ডিম ছাড়ে।

ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে “তিথি” বলা হয়ে থাকে। ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয় ভাষায় “জো” বলা হয়।

এই জো এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা, সেই সাথে নদীর উজানে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত (Thunder-storm) । এর ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয় যাতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়।

পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলক ভাবে অল্প ডিম ছাড়ে।

ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে ফেলে। মাছের ডিম ও রেণু সংগ্রহের উপযুক্ত সময় হল বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার প্রবল বর্ষণ।

এসময় নাজিরহাট, সাত্তারহাট, আজিমারঘাট, বৈদ্যের হাট, রামদাশ মুন্সীরহাট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মিহি মশারির নেট দিয়ে ডিম ও রেণু নৌকায় সংগ্রহ করা হয়।

মাছের ডিম ও রেণু সংগ্রহের পদ্ধতি এখনো প্রাচীন

মাছের ডিম ও রেণুহালদা একমাত্র নদী যেখান থেকে আহরিত ডিম স্মরণাতীত কাল থেকে স্থানীয় জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাচীন পদ্ধতিতে নদীর পাড়ে খননকৃত মাটির গর্তে (কুয়ায়) ফোটানো হয় এবং চারদিন লালন করে রেণু পোনা তৈরি করা হয়৷

এ নদীর রুই জাতীয় মাছের বৃদ্ধির হার অন্যান্য উৎসের মাছের তুলনায় অনেক বেশি৷ এতে মৎস্যচাষী ও হ্যাচারি মালিকরা হালদা নদীর রুই জাতীয় মাছের চাষ কিংবা প্রজনন ঘটিয়ে বেশি লাভবান হতে পারে৷

পানিসম্পদ:

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের সুপেয় পানির প্রধান উৎস হালদা নদী। এ নদীর পানিতে হেভি মেটালের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান থেকে কম।

তাই বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির উৎস হিসেবে হালদা নদীর পানি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

পানির বিশেষ গুণগত মান ও পরিমাণের কথা বিবেচনা করে ১৯৮৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা মোহরা পানি শোধনাগারের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে শহরের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে৷

জাতীয় ঐতিহ্য

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হালদা নদী আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য৷ বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণার জন্য ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী হালদা নদী জাতীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যেরও যোগ্যতা রাখে৷

হালদা নদীকে জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য ঘোষণার দাবি অনেকদিন ধরেই জানিয়ে আসছেন তারা৷

হালদা নিয়ে সিনেমা

হালদা নিয়ে সিনেমামাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের হালদা নদী ও এর আশপাশের মানুষের জীবনবৈচিত্র্য নিয়ে আজাদ বুলবুলের গল্পে অভিনেতা তৌকীর আহমেদের নির্মিত ছবির নাম রাখা হয়েছে- হালদা। ছবিটি প্রযোজনা করেছে আমরা ক’জন।
এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী ও এর দুই পাড়ের জেলেদের জীবন নিয়ে চলচ্চিত্রের গল্প আবর্তিত হয়েছে।
এতে অভিনয় করছেন জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, মোশাররফ করিম, ফজলুর রহমান বাবু, রুনা খান প্রমুখ।

চলচ্চিত্রটি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রদর্শিত হয় এবং তৌকির আহমেদ শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন।

বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ 

২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করছে সরকার।

হেরিটেজ ঘোষণা  হালদা নদী বিশ্বে পরিচিতির পাশাপাশি ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেব স্বীকৃতির সম্ভাবনা তৈরি হবে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে হালদা নদী এবং নদী তীরবর্তী ৯৩ হাজার ৬১২টি দাগের ২৩ হাজার ৪২২ একর জমিকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

সরকারের গেজেট অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ এলাকায় ১২টি শর্ত কার্যকর হবে।

শর্তগুলো হচ্ছে—

  •  এ নদী থেকে কোনও প্রকার মাছ ও জলজ প্রাণী ধরা বা শিকার করা যাবে না। তবে মৎস্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে নির্দিষ্ট সময়ে মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করা যাবে।
  • প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কোনও প্রকার কার্যকলাপ করা যাবে না।
  •  ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট/ পরিবর্তন করতে পারে, এমন সব কাজ করা যাবে না।
  • মৎস্য ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কোনও প্রকার কার্যাবলী করা যাবেনা।
  • নদীর চারপাশের বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালী সৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্জ্য নির্গমন করা যাবে না। ৬. কোনও অবস্থাতেই নদীর বাঁক কেটে সোজা করা যাবেনা।
  • হালদা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৭টি খালে প্রজনন মৌসুমে ( ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) মৎস্য আহরণ করা যাবে না।
  •  হালদা নদী এবং এর সংযোগ খালের ওপর নতুন করে কোনও রাবার ড্যাম এবং কংক্রিট ড্যাম নির্মাণ করা যাবে না।
  •  বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ তদারকি কমিটির অনুমতি ব্যতিরেকে হালদা নদীতে নতুন পানি শোধনাগার, সেচ প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা যাবে না।
  •  পানি ও মৎস্যসহ জলজ প্রাণীর গবেষণার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ তদারকি কমিটির অনুমতিক্রমে হালদা নদী ব্যবহার করা যাবে।
  •  মাছের প্রাক প্রজনন পরিভ্রমণ সচল রাখার স্বার্থে হালদা নদী এবং সংযোগ খালের পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
  • রুই জাতীয় মাছের প্রাক প্রজনন এবং প্রজনন মৌসুমে (মার্চ- জুলাই) ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল করতে পারবে না।
নদী নিয়ে প্রথম ওয়েবসাইট বাংলাদেশে

প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা এই নদীকে নিয়েই গড়ে তোলা হলো একটি ওয়েবসাইট৷ নদী নিয়ে এটিই প্রথম এ ধরণের কাজ বাংলাদেশে৷

নদী নিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে যে ওয়েবসাইটটি তৈরি হলো, সেটির নাম ‘হালদারিভার ডট ওআরজি‘৷ এক কথায় নদীকে বাঁচিয়ে রাখার একটি মহৎ চেষ্টা৷

এই প্রক্রিয়ার প্রধান সমন্বয়ক এবং বলা যায় যার চেষ্টাতেই এই ওয়েবসাইটটি তৈরি হয়েছে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া৷

তিনি গনমাধ্যমকে বললেন, বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশবাসীকে হালদা নদী সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করাই প্রথম উদ্দেশ্য৷

অন্যান্য উদ্দেশ্যে সম্পর্কে তিনি জানালেন, হালদা নদীর পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা৷

হালদা নদীর মাইলের পর মাইল আনা হলো সিসি ক্যামেরার আওতায়

হালদা নদীর আটটি পয়েন্টে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বা সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে; পাশা-পাশি নদীটির নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করা পুলিশের একটি ইউনিট।

এই ক্যামেরাগুলো অবৈধ জাল পেতে মা মাছ ধরা, ইঞ্জিন চালিত নৌকার চলাচল বন্ধ, বালু উত্তোলন বা ডলফিন রক্ষায় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ব্যবহৃত হবে।

হালদা নদী বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র, যাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ বলে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের সরকার। এপ্রিল মাসেই এখানে মাছের প্রজনন মৌসুম রয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় নদী; হালদার যৌক্তিকতা ও বিশ্লেষণ:  ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া

হালদা নদীবাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ- কথাটি আক্ষরিক অর্থেই শুধু নয়, সামগ্রিক অর্থেই সত্য। বাংলাদেশের মানচিত্র নদীর কল্যাণেই সৃষ্টি। ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলা ভূখণ্ডের মাটি ও মানুষের সঙ্গে নদ-নদী ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।

সবুজ শ্যামল সৌন্দর্যের চাবিকাঠির একমাত্র বাহক ও নিয়ন্ত্রক। বাংলাদেশে সভ্যতার ক্রমবিকাশ, যোগাযোগ- অর্থনীতির মূল ভিত্তি রচিত হয়েছে নদীকে কেন্দ্র করে তেমনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও মূল ভিত্তি হচ্ছে নদী নির্ভর।

সাহিত্য, গান, নাটক, চলচ্চিত্রে নানাভাবে উঠে এসেছে নদীর প্রসঙ্গ। অথচ আমরা নদীকে নিয়ে কতটুকু ভাবি বা জানি। যে দেশ নদীর কল্যাণে গড়ে উঠেছে অথচ সেখানেই নদী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা খুবই করুণ।

নদী দেশের প্রাণশক্তি। বিশুদ্ধ রক্ত ও শিরা উপশিরায় বাধাহীন রক্ত প্রবাহ ছাড়া যেমন আমরা সুস্থ দেহ কল্পনা করতে পারিনা তেমনি বিশুদ্ধ পানি ও প্রতিবন্ধকতাহীন নদীর প্রবাহ ছাড়া বাস উপযোগী দেশ কল্পনা করা যায় না।

পানির প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় নদ-নদীগুলোতে অসংখ্য চর জেগেছে, নৌ চলাচল, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সব নদীই ভারত, নেপাল, মায়ানমার ও চীনের সাথে মিশে আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ৫৪টি অভিন্ন নদীর প্রায় সবগুলোতেই উজানে পানি প্রত্যাহার এবং পানির অসম বণ্টনের কারণে ভাটির দেশ বাংলাদেশকে ভয়াবহভাবে পানি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির কবলে পড়ছে।

এরকম পরিস্থিতিতে গত কয়েকবছর যাবত কিছু পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন নদী দিবসগুলো পালিত হয়ে আসছে।

এ উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন নদী বিষয়ক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রকাশনা, পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে একটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তা হচ্ছে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশে একটি জাতীয় নদী চাই।

এ বিষয়ে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও “কেন বাংলাদেশে কোন জাতীয় নদী নাই বা কোন নদী আমাদের জাতীয় নদীর যোগ্যতা রাখে?” এই প্রশ্নগুলোর তথ্য ভিত্তিক বা যুক্তি নির্ভর কোন লেখা নজরে আসেনি।

তাহলে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশ বিশেষণটি আমাদের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য? আমাদের দেশে কতগুলো নদী আছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখনো স্পষ্ট নয়।

যাইহোক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত একটি জাতীয় নদী থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

অথচ নদীমাতৃক বাংলাদেশ এবং নদী কেন্দ্রিক অর্থনীতি বাংলাদেশের প্রধান চালিকা শক্তি হওয়া স্বত্বেও স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও আমাদের কোন নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়নি।

আমাদের দেশেতো জাতীয় ফুল, জাতীয় ফল, জাতীয় বৃক্ষ ও জাতীয় পাখিসহ আরো কত জাতীয় বিষয় আছেই কিন্তু নদীমাতৃক দেশের নদী কেন বাদ থাকবে?

সংজ্ঞাকারে জাতীয় নদী কাকে বলে খুঁজতে গিয়ে যদিও সুনির্দিষ্টভাবে এর কোন সংজ্ঞা পাওয়া যায়নি তবে বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েবসাইটের কল্যাণে যেটুকু ধারণা পাওয়া গেল তা অনুযায়ী সাধারণত কোনো নদী যদি একটি দেশের অভ্যন্তরে উৎপত্তি হয়ে সেই দেশের অভ্যন্তরেই প্রবাহিত হয় এবং এই নদী সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় কোন পরিচয় বহন করে, সেই নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়। জাতীয় নদীতে কেবল সেই দেশেরই রাষ্ট্রেরই একমাত্র সার্বভৌমত্ব ও অধিকার থাকে।

তাছাড়া পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে কিছু জাতীয় প্রতিক থাকে, যেমন জাতীয় ফুল, জাতীয় গাছ, জাতীয় মাছ, জাতীয় পশু ইত্যাদি যা সে দেশের জাতীয় ঐতিহ্য বহন করে।

তেমনি আমি মনে করি পৃথিবীর নদী নির্ভর বা নদী প্রধান দেশগুলোতেও জাতীয় নদী থাকবে বিশেষ করে যে নদীর আর্থিক অবদান, যোগাযোগ, পানি, মৎস্য ও কৃষিজ উৎপাদনে, বা পর্যটন ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং নদীটি সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব নদী হলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে সেই নদীকে জাতীয় নদীর স্বীকৃতি দেয়া উচিত।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় নদী রয়েছে যেমন ভারত ২০০৯ সালে গঙ্গা নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করে।

এ ঘোষণার ফলাফল পরিলক্ষিত হয় যখন জাতীয় নদীর মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পদক্ষেপ নেয় ভারত।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে প্রধান এবং যেসব রাজ্যের ওপর দিয়ে গঙ্গা বয়ে গেছে, সেগুলোর মুখ্যমন্ত্রীকে সদস্য করে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটিও গঠিত হয়েছে।

ভারতের জাতীয় নদী গঙ্গা বা দ্য গ্যাঞ্জেস সেদেশের সবচাইতে দীর্ঘ নদী – পাহাড়, উপত্যকা এবং সমতল মিলিয়ে ২,৫১০কিমি লম্বা।

এর উৎপত্তি হিমালয়ের গঙ্গোত্রীয় হিমবাহের তুষারক্ষেত্রে ভগীরথী নদী নামে।

পরে এর সাথে অলকানন্দা, যমুনা, শোন, গুমটি, কোশী এবং ঘাগড়া যোগদান করেছে। হিন্দুদের কাছে গঙ্গা পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র নদী।

বারানসী, হরিদ্বার, এলাহাবাদ প্রভৃতি স্থানে গঙ্গার তীরে বহু মুখ্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন হয়। গঙ্গা সুন্দরবনের বদ্বীপে প্রসারিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।

পার্শ¦বর্তী দেশ পাকিস্তানও সিন্ধু নদীকে ‘কওমি দরিয়া’ বা জাতীয় নদী ঘোষণা এবং প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি সিন্ধু দিবস ঘোষণা করেছে।

নদীবহুল যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিবেচনায় পাঁচটি প্রবাহকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়েছে।

কোনটি সবচেয়ে দূষণ মুক্ত, কোনটি সবচেয়ে প্রাকৃতিক, কোনটি সুদৃশ্যতম, কোনটি আবার প্রবাহিত হয়েছে ঐতিহাসিক সব স্থানের মধ্য দিয়ে।

আবার বাফেলো ছাড়া বাকি চারটি নদীর পুরো অংশ ‘জাতীয়’ ঘোষণা করা হয়নি। যে অংশ নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে পড়েছে, শুধু সেটুকু। আর মিশরের জাতীয় নদী হচ্ছে নীল নদ।

মিশরের জাতীয় অগ্রযাত্রায় নীল নদের অবদান নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। এজন্য মিশরকে বলা হয় নীল নদের দান।

উপরোক্ত দেশসমূহে একটি নদীকে জাতীয় ঘোষণা করার জন্য যে সমস্ত বিষয়সমুহের দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো নদীর উৎপত্তি, বিস্তার এবং সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় অগ্রগতিতে এর ভূমিকা।

এক্ষেত্রে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নদীকেই জাতীয় নদীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের কোন্ নদীকে জাতীয় নদী করা যায় তা নিয়ে এর মধ্যে বেশ কিছু লেখা বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এমনকি কিছুদিন আগে অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকেও একটি মতামত জরিপ করা হয়েছে।

এই লেখা ও মতামত জরিপ থেকে বাংলাদেশে জালের মত ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদীর মধ্যে বেশ কয়েকটি নদীর নাম উঠে আসে তাদের স্বকীয় কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে, উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হচ্ছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী ও হালদা ।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে, শত শত নদীর দেশে একটি নদীকে আলাদা করে চিহ্নিত করার আদৌ প্রয়োজন আছে কী না? এও বলা যেতে পারে, একটি নদীকে জাতীয় ঘোষণা করে বাকিগুলোর ব্যাপারে কী হবে?

কিন্তু আমরা কি আমাদের জাতীয় কবিকে ছাড়া অন্যদের অসম্মান করি ? কোনো কিছুকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার সাধারণ কারণ হচ্ছে, সেটার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়া।

একটি নদীকে জাতীয় ঘোষণা করার অর্থ বাকি নদীগুলোর ব্যাপারে কম মনোযোগী হওয়া নয়।

আমি মনে করি, জাতীয় নদী ঘোষণা করা হলে সেটি নদী সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনার জাতীয় মডেল হয়ে উঠতে পারে।

এর আদলে অন্য নদীগুলোকেও প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য যে বিষয়টি কঠিন হতে পারে তা হচ্ছে, কোন নদীকে ‘জাতীয়’ ঘোষণা করা হবে? কোনটা ছেড়ে কোনটিকে স্বতন্ত্র ধরে ‘জাতীয় নদী’ ঘোষণা করা হবে?

বাংলাদেশের বড় নদী গুলোর সব নদীই ভারত, নেপাল, মায়ানমার ও চীন থেকে উৎপত্তি। প্রায় প্রত্যেকটি নদী কোনো না কোনোভাবে একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত।

ভারত ও পাকিস্তান তাদের প্রধান প্রবাহ যথাক্রমে গঙ্গা ও সিন্ধুকে জাতীয় নদী ঘোষণা করেছে।

আমাদের প্রধান তিনটি নদী- পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা কি এমন মর্যাদা পেতে পারে?

মুশকিল হচ্ছে, তিনটি নদীর উৎপত্তিই আমাদের দেশের বাইরে। পদ্মা তো গঙ্গারই অপর নাম।

যমুনাও বিভিন্ন নামে- সাং পো, ডিহং, ব্রহ্মপুত্র- তিব্বত, অরুণাচল, আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মেঘনার উৎপত্তিও দেশের বাইরে।

বরাক নদীর বিভক্ত ধারা সুরমা ও কুশিয়ারা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফের মিলিত হয়েই আসলে মেঘনা নাম ধারণ করেছে।

জাতীয় নদীর ধারণা থেকে যদি দেশের ভেতরেই উৎপত্তি ও পতন- এমন নদী যদি বেছে নিতে হয়, সে ক্ষেত্রে কর্ণফুলী ও হালদার নাম সবার শীর্ষে উঠে আসে।

কর্ণফুলীর নাম উঠে আসার কারণ এটি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুংলেই জেলার টলাবুং এলাকা থেকে উৎপত্তি হলেও ২৭৪ কি.মি. নদীটির বিস্তৃতি ভারতে খুবই কম।

যে কারণে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর তালিকায় কর্ণফুলীর নাম নেই।

কিন্তু এই নদীর উৎসস্থলের অন্যতম চারটি শাখা নদী কাসালং, মাইনি, রীংকং ও চেঙ্গি নদীর উৎসও ভারতে। কর্ণফুলী ও এর চারটি শাখা নদীর পানিই মূলত: কাপ্তাই হ্রদের পানির মূল উৎস।

এদের মিলিত স্রোতধারাই কর্ণফুলী হ্রদের সৃষ্টি হয়ে কর্ণফুলী নদী নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

কর্ণফুলী হ্রদের কাপ্তাই নামক স্থানে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করার মাধ্যমে মূল কর্ণফুলী নদীকে অনেকটা প্রবাহহীন মানুষ নিয়ন্ত্রিত নদীতে পরিণত করা হয়েছে।

ইছাখালি ও হালদাসহ আরও কয়েকটি ছোট নদী কর্ণফুলীতে না মিশলে একে হয়ত: নদী হিসাবেই সংজ্ঞায়িত করা যেত না।

জাতীয় নদীর জন্য যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় হালদার নিম্নোক্ত বিশেষত্বসমূহের কারণে এটিই দেশের একমাত্র নদী যা আমাদের জাতীয় নদী হিসাবে স্বীকৃতি পেতে পারে।

১. বাংলাদেশের নদী: হালদাকে কেন বাংলাদেশের জাতীয় নদী ঘোষণা করা উচিত ? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা যদি দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর সাথে তুলনা করি যৌক্তিকভাবে হালদার নামটি উঠে আসে।

কারণ হালদা একমাত্র নদী, যার উৎস ও শেষ আমাদের বাংলাদেশে।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার ২নং পাতাছড়া ইউনিয়নের পাহাড়ি ক্রীক থেকে সৃষ্ট হালদা ছড়া থেকে দেশের মৎস্য খনিখ্যাত হালদা নদীর উৎপত্তি।

হালদা ছড়া মানিকছড়ি উপজেলার বেলছড়া ও সালদাছড়া খালের সাথে মিলিত হয়ে হালদা খাল এবং ফটিকছড়ির ধুরং খালের সাথে মিলিত হয়ে হালদা নদীতে পরিণত হয়েছে।

পরবর্তীতে এই নদী চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ৯৮ কি.মি. পথ অতিক্রম করে চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট নামক স্থানে কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

চট্টগ্রামের এই নদীর উৎস, বিস্তার, অর্থনৈতিক অবদানসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে হালদা একমাত্র নদী যাকে আমরা একান্ত আমাদের দেশের নদী হিসাবে দাবী করতে পারি।

২. প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র : চট্টগ্রামের গর্ব হালদা নদী কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে হালদা বাংলাদেশের অদ্বিতীয় নদী।

এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল এবং কালিগনি) প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এবং এটিই দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।

যুগ যুগ ধরে স্থানীয় অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় রুই জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করে নিজস্ব পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদন করে দেশের মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।

৩. প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক: হালদা নদী বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। এই প্রাকৃতিক জিনপুল বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর গুরুত্ব অপরিসীম।

বর্তমানে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রগুলিতে অপরিকল্পিত প্রজনন ও ইনব্রিডিং-এর কারণে মাছের বৃদ্ধি মারাত্মক ব্যহত হচ্ছে এবং বামনত্ব, বিকলাঙ্গতাসহ বিভিন্ন ধরনের জিনগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

রুই জাতীয় মাছের প্রকৃত বংশধরদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিকল্প নাই।

৪. বংশ-পরম্পরাগত রীতিনীতি: হালদা নদী থেকে ডিম আহরণ, আহরিত ডিম থেকে রেণু উৎপাদন এবং পরিচর্যা প্রযুক্তি স্থানীয়দের সম্পূর্ণ নিজস্ব।

স্মরণাতীত কাল থেকে ধর্মীয় অনুভূতি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সংমিশ্রণের এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিম আহরণ, আহরিত ডিম থেকে রেণু উৎপাদন করে আসছে।

স্থানীয় জ্ঞানের মাধ্যমে তাদের এই নিজস্ব পদ্ধতিতে নদীর পাড়ে খননকৃত মাটির গর্তে (কুয়ায়) ডিম ফোটানো হয় এবং চারদিন লালন করে রেণু পোনা তৈরি করা হয়।

বংশ পরম্পরায় ডিম সংগ্রহকারীরা এ প্রযুক্তি এখনো ব্যবহার করে আসছে। এই স্থানীয় প্রযুক্তি আমাদের এ্যকুয়াকালচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৫. আর্থিক অবদান: হালদা নদীকে কেন্দ্র করে সারা বছরে আবর্তিত হয় এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ।

হালদা নদী থেকে প্রাপ্ত ডিম, উৎপাদিত রেণুর পরিমাণ এবং এখান থেকে উৎপাদিত মাছের হিসাব করলে দেখা যায়, এক বছরের চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

এর সাথে কৃষিজ উৎপাদন, যোগাযোগ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যোগ করলে একক নদী হিসাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর অবদান খুবই তাৎপর্যবহ।

৬. পরিবেশ: বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর বিশেষ পার্থক্য মূলত: পরিবেশগত। বর্ষা মৌসুমে নদীর পরিবেশগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে।

এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক।

আমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে বজ্রসহ প্রচুর বৃষ্টিপাত, উজানের পাহাড়ি ঢল, তীব্র স্রোত, ফেনিল ঘোলা পানিসহ নদীর ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বিত ক্রিয়ায় হালদা নদীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে রুই জাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে, যে পরিবেশ বাংলাদেশের অন্যান্য নদ-নদী থেকে স্বতন্ত্র।

৭. প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: ডিম সংগ্রহের মৌসুমে হালদা দুপাড়ে সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ।

স্মরণাতীত কাল থেকে হালদা নদীতে উৎসবমুখর এ কর্মযজ্ঞ চলে আসছে। স্থানীয় জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীরা সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকে এই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য।

জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হয় ডিম ধরার প্রস্তুতি, এসময় পুকুর তৈরি, কুয়া খনন, নৌকা মেরামত ও পার্টনার সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে।

মে-জুলাই মাসে ডিম সংগ্রহের পর রেণুর পরিস্পুরণ, পরিচর্যা, পোনা বিক্রয় চলতে থাকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত।

স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা বছরের এই ৭/৮ মাস কর্মব্যস্ত দিন অতিবাহিত করে। তাই হালদা নদী আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য।

চট্টগ্রাম অ লে সাম্পান ও সাম্পান মাঝিদের জীবন যাত্রা নিয়ে রচিত হয়েছে প্রচুর নাটক, সিনেমা, গান, পালা ইত্যাদি।

হালদা নদীর সাম্পান মাঝিদের বিশেষ ধরনের গান প্রচলিত ছিল যা এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে, এ বিশেষ ধরনের গানকে বলে “হালদা পাডা” গান। তাই হালদা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ।

বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণার জন্য ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী হালদা নদী জাতীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যেরও যোগ্যতা রাখে।

কক্সবাজার ও সুন্দরবন ছাড়া এ দেশে আরও অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, যা নিয়ে আমরা বিশ্ব দরবারে ঐতিহ্যের দাবি জানাতে পারি। চট্টগ্রামের হালদা নদী তেমনি এক সম্পদ।

৮. পানি সম্পদ: হালদা নদী বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরের সুপেয় পানির প্রধান উৎস।

পানির বিশেষ গুণগতমান ও পরিমাণের কথা বিবেচনা করে ১৯৮৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা মোহরা পানি শোধনাগারের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে শহরের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে।

এ নদীর পানিতে হেভি মেটালের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান থেকে কম হওয়ায় বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির উৎস হিসাবে হালদা নদীর পানি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

২০০৭ সাল থেকে হালদা নদীর মদুনা ঘাট এলাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসার দ্বিতীয় প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের পানি উত্তোলন ক্ষমতাও দৈনিক ২ কোটি গ্যালন।

সুতরাং হালদা নদীর অপরিশোধিত পানি চট্টগ্রামের সুপেয় পানির প্রধান উৎস হিসাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

৯. অতি বিপন্ন জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী শুশুক বা ডলফিনের আদর্শ ও নিরাপদ আবাস: শুশুক বা ডলফিন বিশ্বের অতি বিপন্ন তালিকার জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী।

ইংরেজি নাম: Ganges River Dolphin বা South Asian River Dolphin, বৈজ্ঞানিক নাম: Platanista gangetica gangetica এটি সুসুক, শুশুক, শিশু, শিশুক, শুশু, হুস্তুম মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন নামেও পরিচিত।

এই শুশুক প্রজাতি প্রাথমিকভাবে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী ও বাংলাদেশ ও নেপালে প্রবাহিত তাদের শাখানদীগুলোতে দেখা যায়। বাংলাদেশে বিশেষকরে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদীতে এদের বাস।

চট্টগ্রামের হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীতে এই ডলফিনের আগমন, বিস্তৃতি এবং অবস্থান এখনো রহস্যাবৃত।

আই ইউ সি এন- এর রেড লিস্ট ২০১২ অনুযায়ী এই নদীর ডলফিনগুলোকে আলাদাভাবে অতি বিপন্ন (Critically Endangered) তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

হালদা নদী এই গুরুত্বপূর্ণ জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী প্রজাতির এক আদর্শ আবাসস্থল। দূষণ এবং খাদ্যাভাবের ফলে হালদা থেকেও আশঙ্কাজনক ভাবে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

তাই বিশ্বের অতি বিপন্ন এই জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীকে সংরক্ষণ এবং ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা অত্যন্ত জরুরী।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটি জাতীয় নদী ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবী।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি বিবেচনা করলে দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ হালদাকে বাংলাদেশের জাতীয় নদী ঘোষণা করা যেতে পারে।

এই দাবী এখন দিন দিন জোরালো হচ্ছে। হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হলে এটি নদী সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনায় জাতীয় মডেল হয়ে উঠতে পারে। এর আদলে বাংলাদেশের মৃতপ্রায় অন্যান্য নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

মতামত দিন